থাংলিয়ানা প্রথম নোঙর (১৮৬৫)
কক্সবাজারে হাওয়া বদল
জুন মাসে আমি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের স্থানীর জ্বরে আক্রান্ত হলাম। দুদিনের মধ্যেই এই দুষ্ট জ্বরে এমন ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে আমাকে ডাক্তার বলল হাওয়া বদল করতে। আমি একশ মাইল দক্ষিণের সাব-ডিভিশন কক্সবাজারের দিকে যাওয়ার মনস্থ করলাম । আমি কৌতূহলী ছিলাম মি.কক্স,যার নামে ওই শহর,তার বিষয়ে বিশ্বাস অনুসন্ধান করতে। কিন্তু আমার মাথাটা কুইনাইনের ডোজে এমন টলোমলো হয়ে দিয়েছিল আমার জন্য বরাদ্দ ছোট পুলিশ ইয়টে উঠে প্রশান্তি লাভ করলাম। দুটো বড় বড় আরামদায়ক কেবিন,নদীতে বেয়ে যাওয়ার জন্য দুপাশে ছয়টি করে দাঁড় সংযুক্ত আছে। ফোম নামের এই নৌযান করে আমি রওনা দিলাম ১১ জুন। অনেক আঁকাবাকা পথ পেরিয়ে এবং দ্বীপসমূহকে ফেলে ১৭ জুন আমরা কক্সবাজার পৌঁছে গেলাম।
বহুবছর আগে মি.কক্স এখানে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন,তিনি এখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে । এটা অনেকটা কাঠের তৈরি শহর বলা চলে । বাংলার অন্য সব জায়গা থেকে ভিন্ন চেহারার। এখনকার বাড়িগুলো মজবুত কাঠের তৈরি । বাড়ির মেঝে তক্তা দিয়ে বানানো,বাড়ির ছাদ শক্ত কাঠের কারুকাজ এবং তালপাতার সমস্বয়ে তৈরি।
পোশাক,চালচলন ধর্ম সবকিছুতে এখানকার বাসিন্দারা বাঙালিদের চেয়ে আলাদা। কক্সবাজারের সরল মনের এই রাখাইন মগেরা সদাহাস্যপ্রিয় এক জাতি। তারা কঠিন কাজ বা পরিশ্রম কী জানে না। কেউ কেউ জাহাজে মাছের ব্যবসা করে,অলস সময়ে সুন্দর রঙচঙে জামা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়, ছোট ছোট তামাকের রোল দিয়ে ধূমপান করে, কানে ফুল গোঁজা থাকে,ঠোঁটে স্মিত হাসি। অগুণতি ভোজন উৎসব চলমান থাকে সারাবছর,নানান জাতের মাছ,সাথে বৈচিত্র্যময় সবজির সমাহার এবং কালো জাতের চাল।এই সমস্ত কিছু নিয়ে আনন্দ উল্লাসে,প্রার্থনায়, নাটকীয় কর্মকাণ্ডে তাদের দৈনিক জীবন কেটে যায়।
পুরুষরা সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে খুব পরিশ্রম করে। কিন্তু যখন তীরে থাকে—তারা কিছুই করে না। আমি যা বলেছি তার বাইরে কিছু করতে দেখা যায় না। তাদের নারীরা নিজ নিজ কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করে। তারা কোনোরকম আড়াল ছাড়াই ঘরে বাইরে সর্বত্র যাতায়াত করে,বন্ধু বা পরিচিতজনদের সাথে নির্দ্বিধায় মেশে, দোকানে বেচা-কেনা করে, সংসারের নানা বিষয়ে খবরদারি করে। বয়স্কদের ওরা খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তরুণীরা ঝলমলে রঙিন সিল্কের জামা পরে, হাতে ছোট্ট ছাতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারা তাদের চকচকে কালো চুল ফিতা দিয়ে মাথার পেছনে যত্ন করে খোঁপা করে,সেই খোঁপায় অর্কিড ও নানান রকমের ফুল সাজানো থাকে।
রাখাইনদের সময়ের হিসাবটা অনেক প্রাচীন এবং একটু অদ্ভুত। তাদের রাতের সময়টা কয়েক ভাগে বিভক্ত। প্রথমত,বাচ্চাদের ঘুমের সময় হলো আটটা থেকে দশটা ।
তারপর বয়স্কদের ঘুমের সময় দশটা থেকে এগারোটা। সবশেষে তরুণদের ঘুমের সময় এগারোটা থেকে বারোটা।এই শেষ সময়টা তরুণ-তরুণীদের মেলামেশার জন্য মুক্ত এবং এই সময়ে তাদের হৃদয়ের লেনদেন ঘটে।
আমার কক্সবাজার আগমনের পরের রাতে আমাকে ‘পই’ নামে পরিচিত বার্মিজ নাটক দেখার জন্য নিমন্ত্রণ করা হলো। আমি যখন নদীতে নোঙর করা আমার নৌযান ‘ফোম’ ত্যাগ করে থিয়েটার দেখতে যাই, তখন সবে সন্ধ্যা হয়েছে। থিয়েটারটি আসলে বড়সড় একটা তাঁবু যা শহরের বাইরের দিকের একটা ময়দানে স্থাপন করা হয়েছে।
নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে আমার জন্য বিশেষ সম্মানজনক ভাবে রাখা ‘সাহেব’ চেয়ারে গিয়ে বসলাম এবং চারপাশে তাকালাম। দারুণ বৈচিত্র্যময় একটা দৃশ্য।সমস্ত জায়গাটা দর্শকে ঠাসাঠাসি,নারী পুরুষ শিশু সবাই মাটিতে বসে আছে। সবাই তামাকের রোল দিয়ে ধূমপান করছে। সবার গভীর মনোযোগ মঞ্চের দিকে,আমার আগমনের সাথে সাথে নাটকও শুরু হলো।
প্যান্ডেলের মাঝে মূল খুঁটিটা নানারকম ফুল পাতার মালায় আচ্ছাদিত। প্যান্ডেলের একপাশজুড়ে মঞ্চ নির্মিত, তবে তা ঘাসের ওপর,দর্শক সমান্তরালে স্থাপিত। মঞ্চকে
আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য কিছু বাঁশের তৈরি অদ্ভুতদর্শন মুখোশকে সারিবদ্ধভাবে সুতোয় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু মুখোশে মানুষের চেহারার নানা অঙ্গভঙ্গির ছবি,কিছু মুখোশে দৈত্যদানোর ভয়াল চিত্র, কিছু জায়গায় ঘোড়া,ভালুকসহ নানান প্রাণীর ছবি।সেই মুখোশচিত্রের সারিটা যে দড়িতে ঝোলানো সেটা একটা ঢেউ খেলানো ভঙ্গিতে নাচছিল। ঝোলানো মুখোশের দড়ির একটা প্রান্ত কোনায় বসা একজনের পায়ের বুড়ো আঙুলের সাথে বাঁধা আছে,তার পায়ের মৃদু নড়াচড়ার সাথে মুখোশগুলো বিচিত্র ভঙ্গিতে নেচে নেচে উঠে দর্শক মনোরঞ্জন করছে।
মঞ্চের বামদিকে বসেছে বাদকদল যাদের মধ্যে ড্রামই হলো প্রধান বাদ্যযন্ত্র। তাদের যে নেতা সে এমনভাবে বাজাচ্ছে মনে হচ্ছে সে একাই একশ। আমি আসন গ্রহণ করার পর দেখা গেল এক চায়নিজ মোড়ল টাইপ লোক জনাছয়েক সহচর নিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মঞ্চে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর শুরু হলো ট্র্যাজিক এক নাটক। যদিও তাদের ভাষাটাষা বোঝার সাধ্য ছিল না কিন্তু ঘটনা অনুমান করে নেওয়া কষ্টকর নয়।একের পর এক নাটকীয়তার মাধ্যমে অভিনয় দর্শক হাততালি কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল।
নাটকের অবসান ঘটতে ঘটতে ভোর হয়ে আসছিল।আমি ইতোমধ্যে দুই ঘণ্টাউপভোগ করে ফেলেছি।এবার বুড়ো লোকদের ঘুমানোর সময় হয়ে এলো। আমি আমার ‘ফোম’ জাহাজের মশারির নিচে ঘুমোবার জন্য উঠলাম।
কক্সবাজার অবস্থানকালে আমার সাথে এক চিন-হলা-ফ নামের এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর পরিচয় ঘটেছিল যিনি কলকাতা ও বার্মার সাথে ব্যবসা করেন।আমি তাঁর কাছ থেকে বার্মা ও বার্মা হতে এখানে বসতি গড়া লোকদের ধর্ম সংস্কৃতি আচার আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইতাম। ভদ্রলোক একটু দার্শনিক ধরনের ভাবধারা রাখেন।তিনি আধ্যাত্মিক সাধকের মতো উত্তর দিতেন। বার্মা থেকে যেসব লোক ব্রিটিশএলাকায় আশ্রয় নিয়েছে তারা মগ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। এরা সব বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
আমার কাছে মনে হয় প্রাচ্যের সকল ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধরাই সবচেয়ে আন্তরিক এবং মানবিক।আমি পরদিন সন্ধ্যায় ফোম জাহাজ নিয়ে সমুদ্রপথে রওনা দিলাম চারপাশ অন্ধকার কিন্তু বেশ চমৎকার হাওয়া বইছিল।
সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন স্থানে ঢেউরের মাধ্যে সামুদ্রিক জৈব রসায়নের প্রভাবে ফসফরাসের উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। মনে হচ্ছিল যেন একরাশ জ্যোৎস্না সমুদ্র থেকে উঠে আসছে ঢেউয়ের হাত ধরে। অনুকূল বাতাসে জাহাজ
এগিয়ে যাচ্ছিল । এই কদিনে আমি আমার অফিসিয়াল পরিদর্শনের দায়িত্ব শেষ করলাম কক্সবাজারে ।সমুদ্র স্নান করলাম, এখানকার বিখ্যাত সমুদ্রের ঝিনুক খেলাম। সব সেরে আবদুল মাঝিকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে বললাম ।
চলবে………
১৫৯ বছর আগে লিখা থমাস হারবাট লুইন এর থাংলিয়ানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২