শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৭:১১ অপরাহ্ন
প্রধান সংবাদ :
আইনমন্ত্রীর প্রস্তাব নিয়ে আন্দোলনকারীরা আলোচনায় বসেছেন হল ছাড়ার নির্দেশে ফাঁকা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বান্দরবানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের ধাওয়া। চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বেনজীরের আহমদের সম্পত্তি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় ধসে একজনের মৃত্যু নাইক্ষ্যংছড়িতে ঘুমন্ত স্বামীর অন্ডকোষ ব্লেড দিয়ে কেটে দিল স্ত্রী! লুট করা অস্ত্র ফেরত দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান : মানব বন্ধনে বম জনগোষ্ঠী থানচিতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত বান্দরবানে ও রয়েছে বেনজীর আহমেদের সম্পদ, দেখাশোনা করেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি

পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ  কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর  অভিযান-থাংলিয়ানা

রিপোর্টারের নাম
  • প্রকাশিতঃ বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৪
  • ২৫৮ জন নিউজটি পড়েছেন

প্রথম নোঙর (১৮৬৫)১. কর্ণফুলীর শহর চট্টগ্রাম

উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ছাড়াই মেঘনা মোহনা দিয়ে নৌপথে চট্টগ্রামের কাছাকাছি পৌছে গেলাম। দিনটা ছিল ১৫ অক্টোবর ১৮৬৪। মেঘনা নদী থেকে সমুদ্রের দিকে যাওয়ার আগে আমরা বামনী নামক স্থানে অপেক্ষা করছিলাম অনুকূল স্রোতের জন্য। অনুকূল স্রোত আসার পর সমুদ্রের পূর্ব উপকূল ধরে দক্ষিণ দিকে একটানা নৌকা বেয়ে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় পৌছে গেলাম। এই নদীর উজানে স্বল্প দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর।

কর্ণফুলী মানে কানের ফুল বা কানের দুল। প্রচলিত মিথ হলো,একবার স্থানীয় এক রাজকন্যার কানের দুল নদীতে পড়ে গিয়েছিল। সেই কানফুল উদ্ধার করতে গিয়ে মেয়েটা মারা যাওয়ার পর নদীর নাম কর্ণফুলী রাখা হয়। এটা অবশ্য অনেক আগের কথা। ইংরেজ আমলের আগে মোগল রাজত্বের সময়কার ঘটনা। তখন এটার আদি নাম ছিল কিনসা-খিয়ং।আমরা ক্রমবর্ধমান জোয়ারের সাথে চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে গেলাম।আমাদের সামনে ঝকঝকে ভোরের আলোয় দেখা গেল অসংখ্য জঙ্গলাকীর্ণ ছোট ছোট পাহাড় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যাদের পেছনে দূরে আরো উদ্ধত বড় বড় পাহাড়ের বৃক্ষশোভিত সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম বিশালাকৃতির ইউরোপিয়ান জাহাজের দীর্ঘাকায় মাস্তুলে ছেয়ে আছে দিগন্তরেখা। ওখানে কয়েকটা চাল বোঝাই ইংলিশ আর আমেরিকান জাহাজও দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু জাহাজ দেখতে ইউরোপিয়ান মনে হয় কিন্তু ওগুলোর মালিক হলো দেশীয় লোকজন।

চট্টগ্রামের বাসিন্দারা বহুকাল থেকেই জাহাজের মালিক এবং নির্মাতা।বঙ্গোপসাগরের জলদস্যুরা (পর্তুগিজ) যখন প্রথম এখানে কলোনি করেছিল তার আগ থেকেই পথে যেতে যেতে নদীর তীরে অনেক জাহাজ নির্মাণের কারখানা দেখলাম। এতে বোঝা যায় এখানকার জাহাজ নির্মাণের প্রাচীন ঐতিহ্য এখনো বিদ্যমান ।শহরটা গড়ে উঠেছে মূলত কর্ণফুলী নদীর উত্তর তীর ঘেঁষে। দেশি লোকদের ঘরবাড়িগুলো সব একই রকম। কাঠের খুঁটি আর বাঁশের বেড়ার সমন্বয়ে তৈরি ।প্রতিটা বাড়ির চারপাশে ফলমূলের ছোট বাগান দিয়ে ঘেরা,যার মধ্যে নারকেল সুপারিগাছেরপ্রাধান্য দেখা যায় বেশি।দেশীয় ঘরবাড়িগুলোর পেছনে অসংখ্য ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা পাহাড়, সেই পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বাংলো দেখা যায়। ইউরোপিয়ান লোকেরা বিশেষত সরকারি কর্মকর্তা, প্ল্যান্টার, চাল ব্যবসায়ী সবাই ওইসব পাহাড়ে বাস করে । নিচু ভূমিতে বন্যার আশঙ্কা থাকে,তাছাড়া কিছুটা অস্বাস্থ্যকরও বটে। চট্টগ্রাম জেলার অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তুলনামূলকভাবে চমৎকার ঠান্ডা আবহাওয়া সত্ত্বেও ইউরোপিয়ানদের কাছে খুব জনপ্রিয় স্টেশন হতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হলো ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব।
ব্রিটিশদের আগমনের আগে চট্টগ্রাম ছিল নানান শক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। পাহাড়ি আদিবাসী, বার্মিজ, পর্তুগিজ, মুসলমান সবাই এই জেলাকে দখল করার জন্য নিরন্তর
যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত ছিল । তার কিছু অতীত চিহ্ন এখনো বিদ্যমান।

২. নতুন কর্মক্ষেত্রের শুরুতে

শুরু থেকেই আমি আমার  নতুন কর্মস্থলকে পছন্দ করে ফেললাম। বছরের শেষ নাগাদ  আমার  পুলিশি কাজের লাগাম শক্ত হাতে ধরে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলাম। সামাজিকভাবে  কিংবা  সরকারিভাবে নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসাটা খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার ছিল। শুধু নোয়াখালীর ম্যাজিস্টেটের খপ্পর থেকে মুক্তি পেয়ে আমার বুক থেকে কয়েক টন ওজনের পাথর  যেন নেমে গেল। ওই লোকটা শুরু থেকে আমার জীবনকে অতিষ্ঠ  করে রাখার সকল ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছিলো। অথচ চট্টগ্রামের কমিশনার এবং ম্যাজিস্ট্রেট দুজনই আমাকে খুব আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেছে।নিজের পছন্দমতো থাকার জায়গা পাওয়ার আগে থাকার একটা ব্যবস্থাও হয়ে গেল এক ইউরোপিয়ানের বাড়িতে।

সেই বাড়িও অন্য ইউরোপিয়ানদের মতো পাহাড়ের ওপর অবস্থিত যেখান থেকে যেখান থেকে নদী এবং গ্রামের মনোরম দৃশ্যাবলি চোখে পড়ে। দক্ষিণে আরো দূরে দীর্ঘ বিস্তৃত সবুজ সমভূমি। নানান ফলজ বৃক্ষশোভিত বন-বনানী,মাঝখানে রূপোলী ফিতার মতো কর্ণফুলী বয়ে গেছে।পূর্বদিকে নীল পর্বতমালার সারি,যেখানে বন্য, হিংস্র প্রজাতির মানুষেরাবাস করে,যাদের সম্পর্কে পরবর্তীকালে বিস্তর তথ্যতালাশ আমি পেয়েছিলাম। পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে বিপুলায়তনের ভারত মহাসাগর, প্রতিদিন সূর্যাস্তের  সময় থেকে স্নিগ্ধ  বাতাস এসে প্রাণ ভরিয়ে দেয়। সেখানে সাদা পালতোলা ইংলিশ জাহাজগুলো দেখে মনে পড়ে যায় অনেক দূরের এক প্রাচীন রাজ্যের কথা।

অল্প কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে ভয়ানক একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিলো। বিশাল জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছিল উপকূল,ধ্বংস হয়েছিল জমির ফসল ।লবণাক্ত জলে প্লাবিত হয়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল ফসলের ক্ষেতগুলো। ঘূর্ণিঝড়টি এত শক্তিশালী ছিল যে এটার আঘাত সুদূর কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ঝড়ের দাপটে বাড়িঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল, হাজার টনের বিশাল জাহাজগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে ধানখেতে আছড়ে ফেলেছিল। করেকটিকে ডুবিয়ে দিয়েছিল নদীতে নোঙর করা অবস্থাতেই। এখন অবশ্য ক্ষরক্ষতির চিহ্ন নিয়েও পরিস্থিতি শান্ত স্থির। কে বলবে এই শান্ত প্রকৃতি একেক সময় কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। শীতের আগমনধ্বনি পাওয়া বাচ্ছিল বাতাসের মৃদুমন্দ ঘ্রাণে। সময় হয়েছে বেরিয়ে পড়ার। সমস্ত জেলাটা ঘুরে ঘুরে দেখব, কোথায় কী আছে,কার কোথার সমস্যা সেসব বিষয়ে খোঁজ নিতে বেরুতে হবে। এটা আমার বাৎসরিক ভ্রমণপর্বের অংশ।

কমিশনার আমাকে প্রথম যে কাজটি দিয়েছিলেন তা হলো চট্টগ্রামের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। আমি অনেক ভেবেচিন্তে কাজটা করেছিলাম। খুব যত্ন করে বিস্তারিতভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধাপগুলো পর্যন্ত স্পষ্টকরে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন যেন ওই  পরিকল্পনাটি  বাস্তবে হয়নি। দশ বছর পড়ো চট্টগ্রাম অরক্ষিত থেকে গেছে।

আমার পদোন্নতির দরখাস্তটা কোনো রহস্যময় কারণে আটকে ছিলো।  ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হওয়ার তালিকার প্রথমদিকে আমার নাম থাকলেও কলকাতা থেকে  আমাকে জানানো  হয় যে যতদিন পর্যন্ত আমি ড্রিল এবং অন্যান্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হচ্ছি,ততদিন পর্যন্ত আমার পদোন্নতি হবে না। বরং আমার জুনিয়ার কেউ পাদোন্নতি লাভ করে আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ব্যাপারটা আমার ক্যারিয়ারের জন্য একটা হুমকিস্বরূপ । কিন্তু আমি কখনোই ওইসব পরীক্ষার ব্যাপারে ভীত ছিলাম না। তাই আমি দেরি না করে ফোর্ট উইলিয়ামে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য একটা দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম। দরখাস্তের  জবাব আসার অবকাশে জেলার উত্তরদিকে ঘুরতে বের হলাম। আমার এক সহকর্মীর একটা বিয়ের দাওয়াত ছিল নোয়াখালীর পাশের জেলা কুমিল্লায়। সে আমার সঙ্গ পছন্দ করে,তাই তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য ফেনী নদী পর্যন্ত তার সাথে গেলাম। তারপর তাকে বিদায় জানালাম।

সীতাকুণ্ডের আগ্নেয় জ্বালামুখ 

ফেরার পথে আমি সীতাকুণ্ডে থামলাম। হিন্দুদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান দেখার উদ্দেশ্যে পাহাড়ে উঠলাম। এই মন্দিরটি নিজামপুর পাহাড় শ্রেণির মাঝখানে একটি শৃঙ্গের ওপর অবস্থিত। পাহাড়ে ওঠার জন্য খাঁজ কেটে পথ করা হয়েছে। আমার দুই দেশীয় ভৃত্য সঙ্গে ছিল। একজন আমার বন্দুকটা কাঁধে নিয়েছে, অন্যজন আমার ছবি আঁকার খাতা বহন করছিল। পায়ে হেঁটে ওঠার পথে একটা পবিত্র পাথর অতিক্রম করলাম যেটিকে হিন্দু সম্প্রদায় পূজা করে। কিছুদূর যাওয়ার পর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের আবাসস্থল।

যিনি এই মন্দিরের সর্বেসর্বা,পূজারিদের কাছ থেকে তাঁর বেশ ভালো অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা আছে। এখানে অনেক প্রাচীন মন্দির আছে যেগুলো জঙ্গলে ঢেকে গেছে। এইমন্দিরে কিছু পাথরের স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে, যার ওপর নানান জাতের পুষ্পার্ঘ্য ছড়ানো।এগুলো শিবলিঙ্গ হিসেবে পরিচিত। মন্দিরের পুরোহিতের সাথে দেখা করা গেল না। তাঁর সেবককে দেখে খুব ব্যস্ত মনে হলো।যে পুরোহিতের গত রাতের খাবারের থালা-বাসন পরিষ্কার করছিল। সে জানালো,তিনি এখন পূজায় ব্যস্ত আছেন,কারো সাথে দেখা করা বারণ আছে এ সময়ে। ঘরের সামনে পাহাড় থেকে নেমে আসা শীতল ঝরনার ধারা নিয়ে আসা হয়েছে কৌশলে। একটা সুপারিগাছকে দুই ভাগে বিভক্ত করে একটা লাইন তৈরি করা হয়েছে। সেই লাইন ধরে জল চলে আসে এখানে। পাহাড়ি ঝরনা নিজস্ব পথ ছেড়ে এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে সেবা দিচ্ছে।

এখান থেকে চন্দ্রনাথ মন্দিরে ওঠার বাকি পথটা পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আমি ঘোড়া থেকে নেমে ইটের তৈরি সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম। প্রায় একহাজার ধাপের এই সিঁড়িপথের মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা আছে ।এখান থেকে নিচে এবং চারদিকে তাকালে মনোরম এক প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মন ভরে যায়। দূর সমুদ্রে সকালের রোদ প্রতিফলিত হয়ে চিক চিক করছে। শান্ত সমুদ্রের ওপর অলস ভঙ্গিতে ভেসে আছে কিছু মাছ ধরা নৌকা। তীরবর্তী অঞ্চলে ঘনসবুজ বন-বনানী ।মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় জঙ্গল কেটে শস্য খেত তৈরি করা হয়েছে। সেইসব খেতের মধ্যে যেসব কালো কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে ওগুলো মানুষ এবং গবাদিপশু। কোথাও কোথাও কচি সবুজ ধানখেত ছড়ানো আছে মাঠজুড়ে। নিচের গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে কাঠুরিয়ার কাঠ কাটার শব্দ। মাঝে মাঝে দুয়েকটা বনমোরগও ডেকে উঠছে থেমে থেমে।

একবার হরিণের ডাকও শোনা গেল। ডানদিকের উপত্যকা পেরিয়ে পর্বতের সারি। যার আগাগোড়া ঘন জঙ্গলে আবৃত।সেই জঙ্গলের মাঝে একটা পথ উঠে গেছে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে। যখন আমি সেদিকে তাকিয়েছিলাম ঠিক তখনই একটা ডোরাকাটা হায়েনা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর ধীর পদক্ষেপে সামনের পথটাপার হয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল।আমরা ধাপে ধাপে উপরে উঠছিলাম সুশৃঙ্খলভাবে নির্মিত সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ।ধাপগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে পাহাড় নিসৃত ক্ষীণ জলধারায় সিক্ত হয়ে থাকার কারণে।

কোথাও কোথাও পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা ধূসর পাথরের নিচ দিয়ে পথ এগিয়ে গেছে।সেই পাথরের গোড়া ঘাস আর ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদে ঢাকা। ইটের তৈরি সিঁড়িটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল একটা সমতল পথের কাছে এসে । দশ ফুট দীর্ঘ ঘাসজঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটা চলে গেছে মাথার ওপর একটা খিলানের মতো ছাদ তৈরি করে। যেতে যেতে পথের শেষে যেখানে আমরা থামলাম সেখানে নিচু ছাদের একটা ছোট দালান,মলিন ঘুপচি অন্ধকার বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না । সামনে কোত্থেকে যেন মৃদু গর্জন এবং হিসহিসানির শব্দ ভেসে আসছিল । হঠাৎ আমাদের মুখে উষ্ণ জলের ছিটে পড়ল একটা প্রস্রবণ থেকে।ওটাই হলো সীতার কুণ্ড ।

আমার লোকেরা ভয় পেয়ে গেল এই ঘটনায়। তারা আমাকে অগ্রসর হতে বারণ করল।আমরা পুরোহিতকে সাথে নিয়ে আসিনি এই পবিত্র স্থানে। এর ফলাফল ভালোহবে না বলে ওদের বিশ্বাস। আমি তাদের বললাম,এত খাটনি করে এখানে উঠেছি ফিরে যাওয়ার জন্য না,ব্যাপারটা পুরো না জেনে আমি ফিরছি না। কথা না বাড়িয়ে আমি এগিয়ে গেলাম এবং নিচু খিলান অতিক্রম করে মন্দিরের ভেতরের অংশে ঢুকে পড়লাম। ঘরের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। মাঝখানে আগুনের লাল আভা জ্বলছে আর নিভছে। জায়গাটা নিঃসন্দেহে ভূতুড়ে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের জন্য আতঙ্কজনক।

আমরা ভেতরের একটা কুঠুরিতে ঢুকলাম।সেখানে বিশ বর্গ ফুটের মতো একটা জায়গাজুড়ে জলের চৌবাচ্চা, সেখান থেকে অগ্নিশিখা নেচে নেচে বেরিয়ে এসে ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি করছে। সেই হলুদ আগুনের শিখার পাশাপাশি জলের ভেতর এক রকমের ভুড়ভুড়ি,চাপা গর্জন ও হিসহিসানি। কিছুক্ষণ আগে আমার সঙ্গীদের অস্তির করে তুলেছিল এই রহস্যময় আগুন ও শব্দ।আমরা যখন এই ভূতুড়ে দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখনই আমাদের চোখের সামনেই হিসহিসানির শব্দটা আগ্নেয়গিরির শক্তি নিয়ে বিপুল এক গর্জনে পরিণত হলো।এবং একই সময়ে দালানের অন্যপ্রান্তও বিকট শব্দে কাঁপতে শুরু করল যেন অসংখ্য দৈত্য তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে। এসব দেখে আমার সঙ্গীরা সব প্রাণের ভয়ে ছুটেবেরিয়ে গেল ।আমার কাছে ব্যাপারটা রহস্যময় লাগল।খোঁজ নেওয়ার জন্য পাশের ঘরটিতে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম এক ধর্মগুরু বিপুল আয়তনের একটা কাঁসার ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে জানালেন এটা দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে পবিত্র জায়গা,দেবতার আবির্ভাব এখানে খুব বিরল একটা ঘটনা, তিনি কাউকে দেখা দেন না। শুধু বিশেষ প্রিয় মোহান্তের সম্মুখেই তাঁর আবির্ভাব ঘটে | আমি চৌবাচ্চার মধ্যে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে আবার তাকালাম,ওই শিখা আমাকে মনে করিয়ে দিল পেন্টিকোস্টের অগ্নিশিখার কথা যেখান থেকে যিশুখ্রিস্টের বাণী অবতীর্ণ হতো ।

আমি নিশ্চিত যে এই অগ্নিশিখাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে জলের মধ্য দিয়ে নির্গত দাহ্য গ্যাসীয় পদার্থের কারসাজিতে,কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম না যে আগুনটা নিজে নিজে জ্বলে উঠছে কীভাবে। অগ্নিশিখাটা কিছুক্ষণ জ্বলে আবার নিভে যাচ্ছে,আবার জ্বলে উঠছে এবং সেখানে কোনো বাষ্পীয় নির্গমন দেখা যাচ্ছে না। আমার লোকজনের এসব বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তারা যত দ্রুত এই পাহাড় থেকে নিচে নেমে যেতে পারে ততই রক্ষা। নিরুপায় হয়ে রহস্য উন্মোচন বাদ দিয়ে আমাকে তাদের সঙ্গী হতে হলো।

চলবে………
১৫০ বছর আগে লিখা থমাস হারবাট লুইন এর থাংলিয়ানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক  ব্রিটিশ  কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর  অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন

এই ক্যাটাগরির আর নিউজ

আজকের নামাজের সময়সুচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:০৪ পূর্বাহ্ণ
  • ১২:০৮ অপরাহ্ণ
  • ১৬:৪৩ অপরাহ্ণ
  • ১৮:৪৯ অপরাহ্ণ
  • ২০:১১ অপরাহ্ণ
  • ৫:২৪ পূর্বাহ্ণ
© All rights reserved ©paharkantho.com-২০১৭-২০২১
themesba-lates1749691102
error: Content is protected !!