থাংলিয়ানা___প্রথম নোঙ্গর (১৮৬৫)
৬. বন্যহাতির মুখোমুখি
অতঃপর সেই সন্ধ্যায় আমি নতুন অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে পাল তুললাম। আমার সঙ্গে আছে অপু এবং হ্লা-পোয়া-থু নামের এক ধূর্ত চাকমা শিকারি।সে নাকি এত দুঃসাহসী যে ভয় কাকে বলে জানে না। হাতির পালের অবস্থান জানার জন্য একটা স্কাউট দলকে আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যারা একদিন আগে এখানে গিয়ে হাতির পালের অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিয়ে আমাদের খবর দেবে যাতে শিকারের প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
বারো ফুট উঁচু একটা ছোট বাঁশের মাচা তৈরি করা হলো একটা ডোবার কাছে।ওখানে হাতির পাল স্নান করতে আসে রাতের বেলা।আমি এই অভিযানের ফলাফল বিষয়ে একটু সন্দিহান।কারণ এ ধরনের অভিযান এটাই আমার প্রথম এবং আমি যে নড়বড়ে মাচায় অ্যামবুশ করতে বসেছি সেটাও যথেষ্ট নিরাপদ বলা যায় না। তখন রাত দশটা বাজে এবং ভীষণ ঠান্ডা পড়ছিল।লোকালয় বা সভ্যতা থেকে বহু দূরের এই অজানা জঙ্গলে বারো ফুট উঁচু একটা ছোট্ট মাচার উপরে আমরা তিনজন একে একে উঠে বসার পর মাচাটা ক্যাচক্যাচ করে উঠে দুলতে করল। কিছুক্ষণ পর দুলতে দুলতে স্থির হলো।আমরা অপেক্ষা করছি কখন সেই বিপুল হস্তির দল স্নান করতে আসবে।
কয়েক ঘণ্টা ধরে বসে আছি এবং সেটা খুব অস্বস্তিকর একটা সময়। অপু তখনই ঘুমিয়ে পড়েছিল এবং আমারও ইচ্ছে ছিল তার মতো ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু আমার পেটের খাবারগুলো তখন এমন মোচড় দিচ্ছিল যে সেটা সম্ভব হলো না।হঠাৎ করে আমার পাশে বসা চাকমাশিকারি খুব সতর্কভাবে তার হাত আমার বাহুতে স্পর্শ করলএবং ইঙ্গিতে সামনের অন্ধকারের দিকে কিছু একটা দেখাতে চাইল। ওই তো! ওরা ওখানে। আমার প্রথম বন্যহাতি দর্শন নক্ষত্রের ধূসর অস্পষ্ট মিশমিশে আলো-আঁধারিতে আমি দেখতে পেলাম পাঁচটির মতো হাতি এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে । আবারো ভালো করে দেখলাম,সংখ্যায় পাঁচটাই আছে। দেখে সন্তুষ্ট হলাম যেসংখ্যায় আরো বেশি নয় ওরা।প্রথমে দেখা গেল বিশাল আকৃতির পুরুষ হাতিটাকে, তারপর ছোট দুটো আকারের হাতি।সবার শেষে মাদী হাতি এলো আরেকটা বাচ্চা হাতিকে নিয়ে। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছি।
আমি ধীরে ধীরে মনস্থির করে বড় হাতিটার কান বরাবর বন্দুকের নলটা তাক করলাম। তারপর আস্তে করে ট্রিগারে চাপ দিলাম।গুড়ুম! সমগ্র বনভূমি কেঁপে উঠল যেন।গুলি খেয়ে বড় হাতিটা যখন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল তখন বাকি চারটা হাতি বনের মধ্যে টর্নেডো সৃষ্টি করে ছুট লাগাল ।সেই মুহূর্তে সদ্য নিদ্রামুক্ত পাজী অপু আমার পাশ থেকে চিৎকার করে উঠল,গুলি খেয়েছে! গুলি খেয়েছে!’ এই সেরেছে! ছেলেটার অতর্কিত চিৎকারে বড় হাতিটার মনোযোগ আমাদের দিকে চলে এলো। এবার বিপুল শরীর নিয়ে হাতিটা সোজা আমাদের নড়বড়ে মাচায় ধাক্কা দিল। আমি শুধু এক পলকের জন্য হাতির শরীরটা দেখতে পেলাম।এরপর সব গোলমাল হয়ে গেল। বিশাল দেহ নিয়ে হাতিটা প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মাচাটা দুমড়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমরা যাবতীয় মালামালসহ ছিটকে পড়লাম নিচে ।
ভাগ্য ভালো নিচে পুরু লম্বা ঘাসের জঙ্গল ছিল, আমরা ওখানে পড়ে দম আটকে মটকা মেরে থাকলাম । এমনকি চোখের পাতা ফেলতেও সাহস করলাম না। আরো ভাগ্য ভালো যে জন্তুটা আমাদের খুঁজে বের না করে শুধু মাচার ওপরই রাগটা ঝেড়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেল ।
আমার শরীরের নানা জায়গা ছিড়ে গিয়েছে,অপুর মাথায় আঘাত লেগেছে, বন্দুকটা ভেঙে গেছে । আমাদের সঙ্গী চাকমা শিকারি স্বীকার করল জীবনে এই প্রথম তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছিল । অতএব আমাদের শিকার অভিযানের খায়েশ ওখানেই মিটে গেল।আমি চট্টগ্রামে ফিরে এলাম অনতিবিলম্বে।
এই সময়টাতে চট্টগ্রাম জেলায় চা-বাগানের ব্যবসায় ইংরেজদের বিনিয়োগ বাড়ছিল ক্রমাগত। সরকার সহজ শর্তে বড় বড় জংলাভূমি চা-বাগানের জন্য বিক্রিকরছিল।ইংরেজদের এই হঠাৎ বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যাপারটা স্থানীয়দের সাথে সংঘাতের সৃষ্টি করে নানাভাবে। নানান জন নানান দাবি নিয়ে হাজির হতে লাগল। কেউ গাছ কাটার ক্ষতিপূরণ চায়,কেউ কৃষি জমির ঘাসের ওপর দাবি করে,কেউবা জমিজমার ক্ষতিপূরণ বিষয়ে।এসব নিয়ে প্ল্যান্টার ও জনসাধারণের মধ্যে একটা বিবাদের আশঙ্কা দেখা দিল। কিছু কিছু ঘটনার পরিণামে রক্তারক্তি এবং মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াল।আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এরকম জটিল পুলিশি তদন্ত কাজ খুব কমই করছি।
সেই সময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে আমি আরো ভালো কোন জেলায় বদলি হতে চাই কি না। তখন চট্টগ্রাম জেলার দুর্নাম ছিল জ্বরজারির ব্যাপারে। আমি বদলির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম।কারণ আমি এখানে ভালোই ছিলাম,স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা আমার ছিল না। তাছাড়া এটাও ভেবেছি যে চট্টগ্রামের মতো খোলামোলো পরিবেশ
আর কোথাও পাব না। এখান থেকে দূরে যে নীল পাহাড়ের ছায়া দেখা যায় দক্ষিণ দিকে, সেটা আমাকে হাতছানি দেয় সর্বক্ষণ।অরণ্যের প্রতি আমার ভীষণ আকর্ষণ কাজ করে সবসময়।গতবার দক্ষিণের অরণ্যে ঘুরতে গিয়ে আদিম অরণ্যের বুনো জীবনের প্রতি জেগে ওঠা সেই তৃষ্ণা যেন আরো বেড়ে গেছে।
আমি দেখেছি আমার জেলার অন্তত অর্ধেক মানুষ আমার মন-মানসিকতার; বিশেষ করে যারা বার্মা থেকে এসে পাহাড়ে বসত করেছে সেই উপজাতি মানুষেরা।আমি তাদের বুঝি,তাদের সাথে মন খুলে মিশতে পারি।যেটা সমতলের বাঙালিদের সাথে পারি না,তারা নিম্নবঙ্গের অন্য জেলার বাঙালিদের মতোই ধূর্ত,কাপুরুষ,মিথ্যাবাদী ধরনের মানুষ। মগ জাতির লোকেরা দেখতে গোবেচারা টাইপ,নির্বিবাদী ধার্মিক,কোনো রকম বর্ণবিভেদ নেই তাদের।আমি তাদের সাথে খেয়ে দেয়ে আনন্দ করতে পারি,বন্ধুত্ব পাতাতে পারি। কিন্তু চট্টগ্রামের বাঙালিরা হলো বেড়ালের চামড়া পরা ধূর্ত শেয়ালের মতো।তারা কখনো আমার ভাই বন্ধুর সমতুল্য হতে পারে না। আমি যদিও চট্টগ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে রাজি ছিলাম না, কিন্তু এখানে পুলিশি কাজের বাইরে অন্য কিছু করার সুযোগ খুঁজছিলাম। একবার যে পুলিশে ঢোকে, সারাজীবন সে পুলিশ হয়ে থাকবে আমি এটাতে বিশ্বাসী নই।
আমি ব্রিটিশ বার্মার চিফ কমিশনার কর্ণেল ফেইরের কাছে বার্মিজ এলাকায় চাকরির আবেদন করলাম।কিন্তু এটা নিশ্চিত জানতাম যে এখানে জোরদার লবিং কিংবা স্বজনপ্রীতি ছাড়া এসব কাজ সফল হয় না।
চলবে………
১৫০ বছর আগে লিখা থমাস হারবাট লুইন এর থাংলিয়ানা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান ১৮৬৫-১৮৭২ পর্ব-৩