বান্দরবান প্রতিনিধিঃ বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোপা বদলাপাড়া। সরাসরি সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। লামা থেকে কিছুটা সড়কপথে যেতে হয়, এরপর ঠাকুরঝিরি ও জঙ্গলঘেরা দুর্গম পাহাড় বেয়ে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হাঁটতে হয়।
এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, মোবাইল নেটওয়ার্ক কিংবা হাসপাতাল—এগুলো কিছুই নেই। আশপাশের অন্তত ২০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো বিদ্যালয়ও নেই। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এখানকার বাসিন্দারা পেলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়—‘পোপা বদলাপাড়া আশা-হোফনূং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। বর্তমানে এখানে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৯ জন, শিক্ষক দুজন। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা তরুণ, উথোয়াইয়ই মারমা।
শৈশব থেকে সংগ্রাম
লামার গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যাপাড়ায় জন্ম উথোয়াইয়ইয়ের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন, এবং তার মা-বাবা পড়াশোনার সুযোগ পাননি, তবে তারা চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে। তাঁর প্রথম স্কুল ছিল বড়বমু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার পর তিনি লামা সদরে আবু তাহের মিয়া নামে একজনের বাড়িতে চলে আসেন। এরপর চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
২০০৯ সালে এসএসসি এবং ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করার পর উথোয়াইয়ই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন উন্মূক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১২ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন থানচির হালিরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, পরে বদলি হয়ে আসেন চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
দুর্গম পাহাড়ে আলোর মিশন
কলেজের সময় থেকেই ছবি তোলা এবং ভিডিও করার প্রতি আগ্রহ ছিল উথোয়াইয়ইয়ের। তিনি দূরদূরান্তে যেতেন এবং ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে ফেসবুকে দুর্গম পাহাড়ের চিত্র তুলে ধরতেন। এর মাধ্যমে তিনি ব্লাড ব্যাংক, মেডিক্যাল ক্যাম্প, শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। এসব কর্মকান্ডে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে, তিনি দুর্গম পাহাড়ের মানুষের দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনতে পান। ২০১৫ সালে তিনি ফেসবুকে ‘উথোয়াই ভয়েজার’ নামে একটি পেজ খুলে এসব গল্প প্রকাশ করতে শুরু করেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
২০১৬ সালে গজালিয়ার দুর্গম ম্রো পাড়ায় শুরু হয় পাড়াভিত্তিক একটি স্কুল। পরে মাচাংঘরের স্কুলটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেন উথোয়াইয়ই। ২০১৬ সালে অনেকের সহযোগিতায় তিন কক্ষের একটি টিনশেড ভবন নির্মাণ করা হয়, যার নাম রাখা হয় পাওমুম থারক্লা, অর্থাৎ ‘কলি থেকে ফোটা ফুল’। এর পর থেকেই আশপাশের পাড়াগুলো থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতে থাকে। তবে টেকসই ভবন নির্মাণের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল। তাই তাদের উদ্যোগে ম্রো শিশুদের দিয়ে ছবি আঁকার কর্মশালা আয়োজন করা হয়, এবং সেই ছবি বিক্রি করে স্কুলের তহবিল সংগ্রহ করা হয়।
২০২১ সালে উথোয়াইয়ইদের উদ্যোগে একটি দোতলা স্কুল ঘর নির্মিত হয়। শাহরিয়ার পারভেজ বলেন, “পাওমুম শুধু স্কুল নয়, এটি একটি সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প। আমাদের কাজ শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে, তবে অনেক সমস্যা রয়ে গেছে, যেমন সুপেয় পানির সংকট।”
নতুন উচ্চতায় শিক্ষার অগ্রযাত্রা
২০২১ সালে উথোয়াইয়ই মারমা লামার সরই ইউনিয়নে ‘চেননৈ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন।
আরো পড়ুন→রোয়াংছড়িতে শীলাওয়াইংসা মহাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল