থ্যালাসেমিয়া একটি মারাত্মক রোগ হলেও সহজে প্রতিরোধযোগ্য। এটি একটি বংশগত রোগ হওয়ায় বাবা-মা দুজনেই এই রোগের বাহক হলে সন্তানও আক্রান্ত হতে পারে।
আর এ কারণে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষ নিজের অজান্তে হয়ে উঠছেন এ রোগের বাহক। শিশুরা বংশগতভাবে তাদের পিতা-মাতা থেকে পেয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণত চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানদের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই রোগীদের রক্তের লাল কণিকা তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।
ফলে তাদের রক্তের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে এবং আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই কারণে এদের ২০ থেকে ৩০ দিন পরপর রক্ত দিতে হয় এবং শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রন বের করার জন্য ওষুধ খেতে হয়।
খুব ছোট শিশুদের মধ্যে রক্তশূণ্যতা, জ্বর, শারীরিক বৃদ্ধি না হওয়া, প্লিহা বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখে থ্যালাসেমিয়া রোগ সন্দেহ করেন এবং রক্তের বিশেষ মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
যেহেতু এই রোগের চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ হয়, সেহেতু মধ্যবিত্ত বা দরিদ্ররা এই রোগে আক্রান্ত হলে ভিখারি হতে বেশি সময় লাগে না। এতো পয়সা খরচ করেও এসব শিশুদের সাধারনত ২০-৩০ বছরের বেশি বাঁচানো যায় না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত লাল কণিকা থেকে নির্গত আয়রনের লিভার, হৎপিণ্ড এবং পেনক্রিয়াসে জমা হতে থাকে একং শরীরের অতিরিক্ত আয়রনের বিষক্রিয়ায় এরা লিভার সিরোসিস, হার্ট ফেইলিওর, প্লিহা বড় হওয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয় এবং এদের শরীরে যৌবনের আগমণ ঘটে বিলম্বে আর এদের শারীরিক বৃদ্ধিও তেমন একটা ঘটেনা।
আজ থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট হোমিও গবেষক ডা. এম এ মাজেদ। তিনি তার কলামে লিখেন, বর্তমানে থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা ‘অ্যানিমিয়া’তে ভুগে থাকেন।
অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।
থ্যালাসেমিয়া দুই ধরনের হতে পারে— আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া বেটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়।
অন্যদিকে বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বিশ্বে বেটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনো কখনো ভূ-মধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় এক লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর এটি একটি মারাত্মক জেনিটিক ডিজিজ বিধায় খুব একটা নিরাময় হয় না বলে সবাই বিশ্বাস করতো।
তবে ইদানিং বিভিন্ন দেশের অনেক হোমিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অগণিত থ্যালাসিমিয়া রোগীকে সমপূর্ণরূপে আরোগ্য করার দাবি করেছেন যাদের ডিসচার্জ করার পর পাঁচ-ছয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়নি।
হোমিও স্পেশালিস্টদের মতে, শতকরা ৫০ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগীকে হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি রোগমুক্ত করা আল্লাহর রহমতে সম্ভব।
আর অবশিষ্ট থ্যালাসেমিয়া রোগীরা পুরোপুরি রোগমুক্ত না হলেও হোমিও চিকিৎসায় তাদের অবস্থা এতটাই উন্নত হয় যে, অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নিলে মাসে বা বছরে একবার রক্ত নিলেই চলে।
হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিতে মনো-দৈহিক গঠনগত চিকিৎসা কনস্টিটিউশনাল নামে এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে যার অর্থ হলো রোগের লক্ষণ, রোগীর শারীরিক লক্ষণ, রোগীর মানসিক লক্ষণ, রোগীর বংশগত রোগের ইতিহাস ইত্যাদি বিচার করে ওষুধ নির্বাচন করা।
এতে চিকিৎসক একজন রোগীর পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয় এবং তাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। হোমিওপ্যাথির দুইশ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে যে, এমন সব কঠিন রোগও খুব সহজে নিরাময় হয়ে যায়, যা অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে একেবারে অবিশ্বাস্য মনে করা হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া থেকে মুক্তির জন্য একজন হোমিও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো চলা উচিত, যিনি রোগীর শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক লক্ষণ বিবেচনা করে সঠিক ওষুধ নির্বাচন করে থাকে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ইদানিং কিছু কিছু হোমিও চিকিৎসক বের হয়েছে তারা রোগীর লক্ষণ নির্বাচন না করে থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে পেটেন্ট, টনিক দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। ওইসব ডাক্তারদের ডা. হানেমান বলে থাকে শংকর জাতের হোমিওপ্যাথ।
হোমিও প্রতিবিধান : রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়। এই জন্য অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করে থাকে, সিয়ানোথাস, এসিড সালফ, ফেরাম মেট, আর্সেনিক এল্ব, অ্যান্ড্রাগ্রাফিস, চায়না, কার্ডুয়াস মেরি, ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, ইউক্যালিপটাস, আলফালফা, থুজা, মেডোরিনামসহ আরও অনেক ওষুধ লক্ষণের ওপর আসতে পারে। সাবধান অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক ছাড়া ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার করলে রোগ আরও জটিল আকারে পৌঁছতে পারে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
বিশেষজ্ঞ হোমিও গবেষক ও জটিল রোগীর চিকিৎসক