রাজধানীর মিরপুর–১৩ এলাকায় অবস্থিত বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট পরিচালিত বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজটি এখনও আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ও তথাকথিত ‘ফ্যাসিস্ট দোসরদের’ প্রভাবমুক্ত হয়নি—এমন অভিযোগ উঠেছে কলেজের শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের একাংশের কাছ থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, কলেজটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর সঙ্গে বর্তমানে কারাবন্দী সাবেক আওয়ামী লীগ সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার ও দীপংকর তালুকদারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো নিজেই বিভিন্ন সময় নিজেকে কামাল আহমেদ মজুমদারের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এছাড়া তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জালাল মোস্তফাকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কলেজটির একাডেমিক প্রধান রেক্টর তরুণ কান্তি বড়ুয়ার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। তাকে পতিত আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে উল্লেখ করে অভিযোগকারীরা জানান, ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর আশীর্বাদেই তিনি কলেজটির রেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তরুণ কান্তি বড়ুয়ার রচিত *“বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য প্রবন্ধ”* শীর্ষক বই নিয়েও কলেজের শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
এদিকে কলেজটির অধ্যক্ষ ড. সঞ্জয় কুমার ধর নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ছিলেন বলেও একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে।
কলেজটির আরেক প্রভাবশালী শিক্ষক মতিয়া খানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি সাবেক প্রভাবশালী সাংবাদিক আবেদ খানের ভাতিজি হওয়ায় আওয়ামী লীগ আমলে কলেজটিতে বিশেষ প্রভাব খাটাতেন। অভিযোগকারীরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কলেজে তার প্রভাব কমেনি। সম্প্রতি এক নারী নিরাপত্তা প্রহরীকে প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে, যা নিয়ে কলেজে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে।
অভিযোগকারীদের ভাষ্য, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজটি এখনও একই চক্রের প্রভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
কলেজটি বর্তমানে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ কমপ্লেক্সের ভাড়া নেওয়া জায়গায় পরিচালিত হচ্ছে। ওই কমপ্লেক্সে ঢাকায় বসবাসরত তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ি বৌদ্ধদের একমাত্র বৌদ্ধ বিহার—শাক্য মুনি বৌদ্ধ বিহার অবস্থিত। পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজের অভিযোগ, কলেজটির কারণে বিহারের পবিত্র পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে এবং ধর্মীয় আচার পালনে তারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজের পক্ষ থেকে বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ অন্যত্র স্থানান্তরের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর জমা দেওয়া হয়েছে। আবেদনটির অন্যতম স্বাক্ষরকারী ডা. অজয় প্রকাশ চাকমা বিষয়টি মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।
ডা. অজয় প্রকাশ চাকমা বলেন, *“বনফুল কলেজটির কারণে বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার পালনে নিয়মিত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ি বৌদ্ধ সমাজের দাবি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কলেজটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া।”
এদিকে কলেজের নিরাপত্তা প্রহরী চয়ন দেওয়ানের বিরুদ্ধে শাক্য মুনি বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় আচার পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি সুমিত্র চাকমা নামে এক বৌদ্ধ দায়ককে জোরপূর্বক বিহার থেকে বের করে দেন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী সুমিত্র চাকমা বিচার ও প্রতিকার চেয়ে পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের আহ্বায়ক বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট নিকোলাস চাকমা এই প্রতিবেদককে জানান, তারা অভিযোগটি পেয়েছেন এবং বিষয়টি তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বনফুল আদিবাসী ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
ভুক্তভোগী সুমিত্র চাকমা অভিযোগ করে বলেন, গত ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে তিনি শাক্য মুনি বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় আচার পালন করতে গেলে কলেজের নিরাপত্তা প্রহরী চয়ন দেওয়ান তাকে জোরপূর্বক বিহার থেকে বের করে দেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তিনি পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন।
আরো পড়ুন→বড়দিনে খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের মাঝে শুভেচ্ছা উপহার নিয়ে বান্দরবান সেনা জোন


