বান্দরবান প্রতিনিধিঃ শীতকাল এলেই নতুন করে জেগে ওঠে পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। প্রকৃতি যেন তার নিজস্ব তুলিতে আঁকে এক অনন্য দৃশ্যপট—নীল আকাশের নিচে কুয়াশার সাদা চাদরে ঢাকা সবুজ পাহাড়শ্রেণি। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে পাহাড়ের চূড়ায় ভেসে ওঠা কুয়াশা আর মেঘের মায়াবী দৃশ্য শীতকালে বান্দরবানকে পরিণত করে পর্যটকদের স্বপ্নের ঠিকানায়।
গত নভেম্বর মাস থেকে জেলার নীলগিরি, নীলাচল, বগালেক, কেওক্রাডং, থানচি, রেমাক্রি, তিন্দু ও চিম্বুক পাহাড়সহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ভোরবেলার কুয়াশা ও মেঘের দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসছেন অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু।

তবে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের মতে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা ও পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের কারণে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। জেলার পর্যটননির্ভর উপজেলা রুমা, থানচি ও আলীকদম দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটকদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংযোগ সড়কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণে যাতায়াতে ভোগান্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
এছাড়া হোটেল-রিসোর্ট, খাবার ও পরিবহন খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় অনেক পর্যটক বান্দরবান ভ্রমণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। পর্যটকদের একাংশের দাবি, বান্দরবান ভ্রমণের মোট ব্যয় অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভ্রমণের তুলনায়ও বেশি পড়ে।

স্থানীয় গাইডরা জানান, এ বছর বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র নতুন করে উন্মুক্ত হওয়ায় শীত মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। ফলে অনেক হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউসে আসন সংকট দেখা দিয়েছে। আগাম বুকিং না থাকলে অনেক পর্যটককে বিকল্প আবাসনের খোঁজ করতে হচ্ছে।
শীতকালকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাহাড়ি এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। পর্যটকদের আনাগোনায় স্থানীয় বাজার, পরিবহন, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন খাতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে।

পর্যটকদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলোতে তথ্যকেন্দ্র ও দিকনির্দেশনা সেবা জোরদার করা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশ পাহাড়ি সড়কগুলোতে নিয়মিত তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, “বান্দরবানের অধিকাংশ পর্যটনকেন্দ্র প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা নেই। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক সময় পর্যটনকেন্দ্রগুলো স্থায়ীভাবে উন্মুক্ত না থাকায় বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে পর্যটন খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন ভাড়ায় সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। এতে পর্যটকদের আস্থা বাড়বে এবং পর্যটন শিল্প আরও গতিশীল হবে।”
টুরিস্ট পুলিশ বান্দরবান রিজিয়নের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার হাসান ইকবাল চৌধুরী বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে দুর্গম এলাকাগুলোতেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে এ বছর পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে।”

চট্টগ্রাম থেকে কেওক্রাডং ভ্রমণে আসা পর্যটক আব্বাস উদ্দিন বলেন, “বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, ভোরের মেঘ আর এখানকার মানুষের আতিথেয়তা অসাধারণ। তবে বগালেক ও কেওক্রাডং ভ্রমণে যেসব নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে, সেগুলো দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। অযৌক্তিক গাইড বাধ্যবাধকতা ও অতিরিক্ত যাতায়াত খরচ কমানো গেলে পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ আরও সহজ হবে।”
পড়ুন→নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বিপুল পরিমাণ অবৈধ কাঠসহ পিকআপ জব্দ
ভ্রমণপিপাসুদের মতে, শীতের কুয়াশায় মোড়া পাহাড়, মেঘের ভেলা আর সবুজ বনানীর মেলবন্ধনই তাদের বারবার বান্দরবানে টেনে আনে। প্রতি বছরের মতো এবারও শীতকাল মানেই পর্যটকদের কাছে স্বর্গ—বান্দরবান।


