আকাশ মারমা মংসিং >>
পানির জন্য হাহাকার করছে দুর্গম এলাকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। তীব্র দাবদাহের ফলে গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। তৃষ্ণা মেটাতে কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানির খোঁজেন বান্দরবানের দুর্গম এলাকার বসবাসরত পাহাড়িরা। মাথায় কলসি কিংবা থুরু নিয়ে পানির সন্ধানে যান ঝিরি-ঝর্ণাগুলোতে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কারণে দুর্গম এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। নদী ও ঝিরির দূষিত পানি পান করার ফলে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে কোমলমতি বাচ্চাসহ বয়স্করাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবান জেলায় দুর্গম ও সমতল এলাকায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর গ্রাম রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬শ’রও অধিক। জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখেরও বেশি। তার মধ্যে সদর উপজেলার অধীনে শহর থেকে চিম্বুক সড়ক হয়ে জীবন নগর পর্যন্ত মোট গ্রাম রয়েছে ৫৬টি। সেসব গ্রামগুলোতে জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার অধিক মানুষের জীবনযাপন। সেসব দুর্গম এলাকার গ্রামে পানির সংকটে রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ। যেখানে শুষ্ক মৌসুম এলে প্রধান সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয় সপেয় পানির। বর্তমানের ঝিরি-ঝর্ণাগুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে অথৈই পানি সংকট। যার ফলে পানির তৃষ্ণা মেটাতে হাহাকার হয়ে পড়েছে দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠী।
দুর্গম এলাকার জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ঝিরি ও খালগুলোতে মিলত প্রায় ৩০ জাতের প্রাণী। যেমন- কাকড়া, শামুক, কচ্ছপ, গুইসাপ, ছোট ছোট মাছসহ নানা ধরনের জীববৈচিত্র। বর্তমানে এসব ঝিরিতে পানিও মিলছে নাহ। সেসব ঝিরিতে পাথর থাকার সময় পানি ছিল স্বচ্ছল ও পরিষ্কার। অথচ এখন সেই ৩০ জাতের প্রাণীসহ পাথরগুলো হারিয়ে গেছে। খালের পানি শূন্যতার কারণে মৃতপ্রায় পানি প্রবাহিত ছোট শাখা-প্রশাখা ঝিরিগুলো।
পানি সংগ্রহ করছেন এক নারী।
তাছাড়া বান্দরবানে অধিকাংশ এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শত কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা রিংওয়েল -টিউবওয়েল ও জিএফএস লাইনগুলো পড়ে রয়েছে অকেজো অবস্থায়। সরকারের এমন অর্থে নয়ছয় ফলে পাহাড়ের ভয়ঙ্কর রূপধারণের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পাহাড়ের বসবাসরত ম্রো, মারমা, বম, চাক, তংচঙ্গ্যা, খুমি সহ প্রায় ১১টি জনগোষ্ঠীর।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহর কেন্দ্রিক টিএনটি পাড়া, টাইগার পাড়া, টংকাবতী, বেথনি পাড়া, গেসমনি পাড়া, ওয়াই জংশন, ১২ মাইলসহ দুর্গম এলাকার গ্রামগুলোতে একই চিত্র। পানি উৎস ঝিড়ি-ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে যাওয়া ফলে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন নদী-খাল ও ছোট-খাটো ঝিরিতে গ্রীষ্মকাল শুরু হলে পানি বহমান হয় না, ঝিরি-ঝর্ণা নয় শুধু, শুকিয়ে গেছে গাছের শিকড়ও।
দুষিত পানিতে বাচ্চার গোসল।
প্রায় ২-৩ ঘণ্টা পায়ে হেটে পানি খোজে দীর্ঘপথ তারা পাড়ি জমান ঝিরি-ঝর্ণায়। পানির দেখা মিললেও সে পানি আবার দূষিত। ঝিরিতে জমে থাকা দূষিত পানি নিতে অপেক্ষা করতে হয় ২-৩ ঘন্টা। আর এসব পানি পানে ডায়রিয়া, জন্ডিস,পাতলা পায়খানাসহ নানান রোগের ভুগতে হচ্ছে বাচ্চাসহ বৃদ্ধরাও।
“গত ২০২১ সালে বিশুদ্ধ পানির অভাবে আলীকদমের কুরুকপাতায় ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রান দিতে হয়েছিল ম্রো জনগোষ্ঠীর ৭জনকে । ২০২২ সালে দুর্গম এলাকার থানচিতে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আরো ৮ জন। তাছাড়া এই পানি সংকটের ফলে নানা ধারণের রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল দুর্গম এলাকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠিরা”- স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র।
এদিকে খাল ও ঝিরি থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন, বৃক্ষনিধন, পাহাড় কর্তনের কারণে দিনদিন শুকিয়ে গেছে ঝিরি-ঝর্ণার পানির উৎস। কমে গেছে সাঙ্গু খালে পানি স্তর। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে পাহাড় ধ্বংস হবে বলে মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন বান্দরবান চ্যাপ্টারে সভাপতি জুয়ামলিয়ান আমলাই বম বলেন, আমাদের দেখা প্রায় তিনশ থেকে চারশ ঝিড়ি-ঝর্ণা জীবন্ত, যেখানে বারো মাস পানি পাওয়া যেত সেখানে এখন আর পানি নাই। গাছকাটার যে মহোৎসব, তার পাশাপাশি পাথর তোলার মহোৎসব, তথাকথিত উন্নয়ন নামে যেসব পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে বড় বড় পাহাড় ও ঝিরিগুলো শুকিয়ে যাবে তার কোন সন্দেহ নাই। তাছাড়া এখন জলন্ত প্রমাণ পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকার গ্রামগুলো পানি জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। আগামীতে এই পানির সংকটে প্রভাবে পাহাড়িরা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে- এটাই শুধু দেখার বাকি থাকবে।
টিএনটি গ্রামের বাসিন্দা উম্রাচিং মারমাসহ বেশ কয়েকজন জানান, তাদের গ্রামে ৫০টি পরিবারের বসবাস। সবাই জুমের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক মৌসুমে খাবার পানি সংকটে পড়তে হয়। তিন ঘণ্টা পায়ে হেটে কোয়ার মধ্যে যে পানি পাওয়া যায় সেটিও দূষিত। না পারছি পানি খেতে না পারছি গোসল করতে। এমন হাহাকারে জীবন কাটছে আমাদের।
টংকাবতী ব্রিকফিল্ড পাড়ার বাসিন্দা তোয়েং ম্রো বলেন, আমাদের এখন প্রধান সমস্যা পানি। প্রায় সময় পাথর তুলে নিয়ে যায়। যার ফলে পানি শুকিয়ে গেছে। সেই দূষিত পানি খাওয়ার কারণে বাচ্চাদের বিভিন্ন রোগে ভুগতে হচ্ছে।
জামিনী পাড়ার বাসিন্দা ঙাংরে ম্রো বলেন, গ্রাম থেকে ঝিরিতে যেতে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে আবার পানি পাওয়া যায় না। যেই পানি পাওয়া যায় তা গন্ধ, তবুও খেতে হচ্ছে।
বান্দরবান দুর্নীতি প্রতিরোধ সভাপতি অংচমং মারমা বলেন, চিম্বুক সড়কের অধিকাংশ পাহাড়ি গ্রামে তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। নির্বিচারে ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন, গাছ কাটার ফলে প্রকৃতি এখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এটি দিনদিন প্রচণ্ড খরা হয়ে দুর্ভক্ষে পরিণত হচ্ছি। প্রশাসন ও সর্বস্তর মানুষ যদি এই জলবায়ুকে সঠিক রাখতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে পাহাড়ের অবস্থা আরো দুর্ভিক্ষের পথে যাবে।
বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, নির্বিচারের পাহাড় ধ্বংস করার কারণে পানি সংকটে দেখা দিয়েছে। পানি মূলত পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্ণায় পাথরে লেগে থাকে। পাথর উত্তোলন করা কারণে পাথরের গায়ে পানি লেগে থাকতে পারছে না। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখতে না পারার কারণে দিনদিন পানি দ্রাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। এই অবস্থায় যদি চলতে থাকে ভবিষ্যতে পাহাড়ের সমস্যা দেখা দিবে। তাই আগামীতে আমাদেরকে আরো সচেনতা থাকতে হবে।