বিনোদন ডেস্ক>>
অনলাইন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিরো আলমকে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও মুচলেকা আদায়ের ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
হিরো আলমের অভিযোগ, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুল গীতি না গাওয়ার ব্যাপারে তার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়েছে পুলিশ। তার নামের প্রথম অংশ ‘হিরো’ পরিবর্তন করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের পোশাক পরে অভিনয়ে আপত্তি জানিয়েছে ডিবি।
রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতের মতো কপিরাইটবিহীন গান নিজের মতো করে কেউ গাইতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তাতে বাধা দিতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কারও নাম পরিবর্তনের নির্দেশনা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
সু্প্রিমকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না মনে করছেন, এ কাজের ধরনের দায়িত্ব পুলিশের নয়। তিনি বলেন, ‘পুলিশ হিরো আলমকে গান না গাইতে এবং নাম পরিবর্তনের জন্য যে মুচলেকা নিয়েছে, সেটা পুলিশ পারে না। এটা অসম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘ইউটিউব না থাকলে হিরো আলমের নামই কেউ জানতো না। এ ধরনের কনটেন্ট পুলিশ বিটিআরসিকে সরিয়ে দিতে বলতে পারে, কিন্তু ডেকে নিয়ে এভাবে মুচলেকা নিতে পারে না।
হিরো আলমকে ডেকে নিয়ে পুলিশের মুচলেকা নেয়ার ঘটনায় ‘খুবই অবাক’ হয়েছেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ পুলিশের ড্রেস পড়েছে, তার জন্য হুঁশিয়ার করতে পারে, কিন্তু গান না গাইতে মুচলেকা নিতে পারে না।
‘সে (হিরো আলম) যেভাবে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছে তার জন্য খারাপ লাগছে। তার মানে এই নয় যে, পুলিশ এটা করতে পারে।’
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, ‘পুলিশ যেটা করেছে, সেটা আমার কাছে মনে হয় না আইনসিদ্ধ হয়েছে। কারণ কে গান গাইবে, কে গাইবে না বা তার গান গাওয়ার ক্ষমতা কতটুকু- তা নির্ভর করছে ব্যক্তির উপরে।’
গান না গাওয়ার জন্য মুচলেকা নেয়া ‘বিরল ঘটনা’ উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, ‘এমন ঘটনা আর ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুচলেকা নিতে পারে, কিন্তু গান গাইবে না এমন মুচলেকা নিতে কোনো আইন আছে কিনা আমার জানা নেই।
‘অভিনয়ের সময় পুলিশ, আর্মি বা কোনো বাহিনীর পোশাক পরতে হলে ওই বাহিনীর একটা অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতি না নিয়ে থাকলে পুলিশ তাকে বাধা দিতেই পারে। তবে গান না গাওয়ার জন্য মুচলেকা নেয়ার বিষয়টি বেআইনি হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। এটা ব্যক্তির মৌলিক অধিকারে বাধা দেয়ার শামিল।’
ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ডাকে বুধবার সকালে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে উপস্থিত হন হিরো আলম। সেখানে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পরে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘হিরো আলমের কথা আর কী বলব! পুলিশের যে ড্রেস, যে প্যাটার্ন, ডিআইজি, এসপির যে ড্রেস তা না পরে কনস্টেবলের ড্রেস পরে ডিআইজি, এসপির অভিনয় করছে।
ডিএমপির কমিশনার শিল্পী সমিতিতে বলেছেন, পুলিশের পোশাক পরে অভিনয় করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু হিরো আলম শিল্পী সমিতির সদস্যও না। সে অনুমতি ছাড়া পুলিশের পোশাক পরছে। কনস্টেবলের ড্রেস পরে এসপি, ডিআইজির অভিনয় করছে। এটা সে জানেও না।’
তিনি আরও জানান, হিরো আলম যেভাবে গান গান তাতে রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীত পুরোটাই চেঞ্জ হয়ে যায়।
হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমরা জিজ্ঞাসা করেছি, আপনি এসব কেন করেন? তখন হিরো আলম আমাদের বলেছেন, আমি আর জীবনে এসব করব না। আমি আর পুলিশের পোশাক পরব না। কোনো ধরনের রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গাইব না।’
হিরো আলম পরে সংবাদ মাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, গান বিষয়ে মুচলেকা নেয়ার পাশাপাশি তার নাম থেকে ‘হিরো’ শব্দটি ছেঁটে ফেলতে বলেছে পুলিশ। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে ‘তুলে নিয়ে’ যায় বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। তবে এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি সংগীত ঐক্যের দুই মহাসচিবের একজন নকীব খান। এ ছাড়া আরেক মহাসচিব কুমার বিশ্বজিৎ-এর সঙ্গে অনেকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।
লেখক, প্রকাশক ও সংস্কৃতিকর্মী রবীন আহসান মনে করছেন হিরো আলম কোনো ‘শিল্পী নন’, তাদের কর্মকাণ্ড এমনিতেই একদিন থেমে যাবে।
তবে পুলিশের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করছেন না রবীন আহসান। তিনি বলেন, ‘যে যার মতো করে গান তো গাইতেই পারে। আমরা তো একজন বাউলের গান বন্ধ করতে পারব না। পুলিশ আমাদের দেশে বাউলের গান বন্ধ করেছে বিভিন্ন জায়গায়। তারপর আমাদের গ্রামেগঞ্জে সব জায়গায় ওয়াজ-ধর্মীয় সংস্কৃতি এটা বেড়েছে। আমাদের কবিগান-লোকগান যাত্রা বন্ধ করে ধর্মীয় উন্মাদনা বেড়েছে।’
‘পুলিশ দিয়ে ঠেকানো-বন্ধ করা এটা আমি মনে করি ঠিক হয়নি এবং এটা আমাদের জন্য আখেরে খারাপ হবে। আমরা তো হিরো আলমরে ঠেকিয়েছি, এখন তারা যদি মনে করে অন্যদেরও; যারা দেশের ভালোর জন্য গান করছে, কিন্তু দেশদ্রোহী বলে পুলিশ তাদেরও ডেকে নিয়ে যাবে। ফলে এটা একটা বিপদজনক সংস্কৃতি হিসেবে দাঁড়াল।’
বগুড়ায় ডিশ লাইনের ব্যবসা দিতে গিয়ে স্থানীয়ভাবে ভিডিও ছেড়ে হিরোর কনটেন্ট তৈরির শুরু। পরে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে তৈরি হয় হাস্যরস। তবে দমে না গিয়ে, সমালোচনা গায়ে না মেখে একের পর এক ভিডিও বানাতে থাকেন তিনি। সেই সঙ্গে শুরু করেন গান।
পরে বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, আরবি, চীনা এবং আফ্রিকান সোয়াহিলি ভাষায় গান তিনি। তৈরি করেন সিনেমা। লেখেন বই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নেন তিনি।
স্পষ্টতই সমালোচনা, কটাক্ষ গায়ে মাখছেন না হিরো আলম। মফস্বল থেকে উঠে এসে রাজধানীর বুকে তিনি অবস্থান নিয়ে যে বেশ আয় করছেন, সেটি তার জীবনাচরণেও ফুটে উঠে। তিনি গাড়ি কিনেছেন, নিয়েছেন অফিসও।