গত ১৬-১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের সার্বভৌম সীমা লঙ্ঘন করে সীমান্তের ১০ কিলোমিটার ভেতরে বান্দরবানের সীমান্তবর্তী থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের রেমাক্রি মুখ এলাকায় সামরিক পোশাকে অনুপ্রবেশ করে স্থানীয় পাহাড়িদের সাথে জলকেলি উৎসবে অংশগ্রহণ আরাকান আর্মি। ওই উৎসবের সচিত্র ভিডিও আরাকান আর্মি তাদের সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাকাউন্টে শেয়ার করলে বিষয়টি সারা বাংলাদেশে সমালোচনার ঝড় তুলে।
জানাযায়, আরাকা ওয়াটার ফেস্টিবল নামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় মিয়ানমারের সশস্ত্রবিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউএলএর অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে প্রায় ১০ কিমি. অভ্যন্তরে এই ধরনের আয়োজনকে সরাসরি সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আরো জানাযায় মঞ্চ ও আশপাশজুড়ে ছিল রাখাইনের ইউএলএ ও আরাকান আর্মির পতাকা ও প্রতীক। উৎসবে বাংলাদেশী মারমা ও অন্যান্য স্থানীয় পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আরাকান আর্মির ইউনিফর্মধারী ও অস্ত্রধারী সদস্যরা প্রকাশ্যে অংশ নেয় এবং মঞ্চে উঠে আনন্দ উল্লাস করে বলেও জানাযায়। এছাড়া আয়োজনের অংশ হিসেবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি এবং বক্তব্য তো ছিলই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও নিষ্ক্রীয় দেখা গেছে সেই অনুষ্ঠানে।
জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখার জন্য সেখানে বিজিবি সদস্যরা অবস্থান করেন বলে উল্লেখ করে বিজিবির।
গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল চলা এই ‘জলকেলি’ অনুষ্ঠানে মূলত সঙ্গীত পরিবেশনা ও নৃত্যকেই প্রধান আকর্ষণ বানানো হয় যাতে আরাকান আর্মির সক্রিয় সদস্যরা বিশেষ করে নারীদের দ্বারা সঙ্গীত পরিবেশন করানো হয়। সেইসাথে ছেলে সদস্যদের ও সঙ্গীত পরিবেশন করতে দেখা যায়। অনুষ্ঠানটি দিন থেকে শুরু করে রাত উভয় পর্যন্ত চলতে থাকে। চলমান সঙ্গীত ও নিত্য পরিবেশনাকালে আঞ্চলিক নেতারা গায়ক-গায়িকাদের সাথে উল্লাসে মেতে ওঠে এবং গায়ক গায়িকাদের অর্থ পুরস্কার দিতে দেখাযায়; সেইসাথে আরাকান আর্মির অফিসারদের অস্ত্রসহ নাচতে ও অফিসারদের একজনকে বক্তৃতা দিতেও দেখা যায়।
আরাকান আর্মির কৃতক প্রকাশিত ভিডিওচিত্রে বার্মিজ ভাষায় দেয়া একাধিক বক্তব্যে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক অভিপ্রায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। তাদের বক্তব্যে আয়োজকগণ দাবি করেন যে, “এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব আমরা পার্বত্য জেলায় সফলভাবে আয়োজন করতে পেরেছি শুধু আরাকান আর্মির সহযোগিতার কারণে। আমরা তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।”
এতে বক্তারা আরো বলেন, “অনেক দিন ধরে আমরা এই ধরনের একটি সম্মিলিত মিলনমেলা আয়োজনের চেষ্টা করে আসছিলাম, কিন্তু নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে, বার্মিজ সাল ১৩৪৬-এ আরাকান আর্মির সহায়তায় আমরা স্বাধীনভাবে এই উৎসব আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছি। এটি আমাদের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।”
তারা উল্লেখ করেন, “অতীতে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ নানা বাধা ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল, কিন্তু আজ আরাকান আর্মির সহযোগিতায় আমরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারছি। যেভাবে আরাকান আর্মি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমাদেরও উচিত তাদের পাশে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। এটি আমাদের আত্মপরিচয় ও সম্মান পুনরুদ্ধারের প্রতীক।”
আগত অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তারা বলেন, “দূর-দূরান্ত থেকে যারা এসেছেন, তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল।” বক্তব্যের শেষাংশে রাজনৈতিক ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “এখন সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। অতীতে আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম, কিন্তু এখন আমাদের প্রয়োজন সম্পূর্ণ ঐক্য। আসুন সব বিভেদ ভুলে একত্র হই এবং সম্মিলিতভাবে সামনে এগিয়ে যাই।” স্থানীয়দের ধারণা, এই ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে দু’টি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
প্রথমত. আরাকান আর্মি এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একাংশের কাছে তথাকথিত মুক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয়ত. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে তারা একটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে একীভূত হওয়ার পথে অগ্রসর হতে চাইছে। এ বক্তব্য নিছক কৌশলগত নয়, এটি আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার এক বিপজ্জনক ইঙ্গিত বহন করে, যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ সংহতির জন্য গভীর হুমকি।
ভিডিওতে দেখা যায়, উৎসবে থাকা একজনের পরনে থাকা একটি টি-শার্টে বাংলায় ‘মেম্বার পরিবার’ লেখা রয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তাদের সমর্থকদের সংগঠিতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নির্দিষ্ট পোশাকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিয়েছিলেন।
ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী এটি কোনো বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয় বরং এটিকে একটি পরিকল্পিত, প্রতীকী এবং বাস্তব কৌশলগত ‘সার্বভৌম মহড়া’ হিসেবে দেখা যায়।
এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াসির জাহান হোসেন বলেন, আমাদের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল বান্দরবানের দুর্গম এলাকা রেমক্রিতে বৈশাবী উৎসবে আরাকান আর্মির সদস্যরা অংশগ্রহণ করতে পারে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বর্ডারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াই। বৈশাবী অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার স্বার্থে বিজিবির সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আরাকান আর্মির যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সেখানে একজন নারী পায়ে সেন্ডেল পরে এবং প্যান্টে যে ছাপা ছবিতে দেখা গেছে সেটি আরাকান আর্মির পোশাক নয়। অনুষ্ঠানটি মূলত স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ আয়োজন করে থাকে। তিনি বলেন, আমার জানা মতে, আরাকানরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি। তবুও আমাদের গোয়েন্দারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, পার্বত্য জেলা বান্দরবান পুলিশ সুপার মো: শহিদুল্লাহ কাওছার গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আরাকানরা বান্দরবানে বৈশাবী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে এমন একটি তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। তবে বিষয়টি কতটুকু সত্য তা উদঘাটন করতে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। জায়গাটি দুর্গম, তাই তথ্য উদঘাটনে একটু সময় লাগবে।
উল্লেখ্য, থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নে অবস্থিত রেমাক্রি মুখ অঞ্চলটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থান করছে। এটি কোনো বিতর্কিত অঞ্চল নয় বরং স্বীকৃত ও সরাসরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ভূখণ্ড। এই এলাকা কৌশলগতভাবে উচ্চ অগ্রাধিকারের, যেখানে এক দিকে রয়েছে পর্যটন সম্ভাবনা, অন্য দিকে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতি ও নেটওয়ার্ক। এমন স্পর্শকাতর ভৌগোলিক অবস্থানে আরাকান আর্মির সরাসরি কার্যক্রম শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও কর্তৃত্বের ওপর একটি স্পষ্ট ও সুপরিকল্পিত চ্যালেঞ্জ।
আরো পড়ুন→পার্বত্য চট্টগ্রামে মার্কিন নাগরিকদের ভ্রমণ না করার পরামর্শ মার্কিন দূতাবাসের